বিশেষজ্ঞরা আছি, সাংসদদেরও দায়িত্ব নিতে হবে

স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাবিষয়ক (অটিজম) জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বলেছেন, ‘বিশেষজ্ঞ হিসেবে অটিজম বিষয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য আমরা তৈরি আছি। কিন্তু জনসচেতনতা তৈরিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে আরো বলেন, ‘কারণ আপনারা (সংসদ সদস্যরা) মাঠপর্যায়ে থাকেন। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরিতে আপনারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।’
আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের শপথকক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উদ্যোগে ও সংসদ সচিবালয় আয়োজিত স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাবিষয়ক (অটিজম) কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
অর্টিজম কোনো রোগ নয় উল্লেখ করে অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন বলেন, তবে এতে সাধারণ জীবনযাপন যেমন- স্বাভাবিক হাঁটাচলা, কথাবার্তা, আচরণ, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতিতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রতিবন্ধী সমস্যা দূর করার জন্য যথাসম্ভব কম বয়স থেকেই শিশুর যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। কেননা একটি শিশুর সাত বছর পর্যন্ত মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটে থাকে। এ ধরনের শিশুদের কাউন্সেলিং, থেরাপি ও সময়মতো প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া জরুরি। এ বিষয়ে বাবা-মাকে সচেতন থাকতে হবে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে মানবসম্পদে পরিণত করতে সংসদ সদস্যসহ সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে অটিজম সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা বদলাতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীতনয়া বলেন, ‘শিশু তিন বছরের কথা বলতে না পারলে তার মায়েরা চিন্তায় পড়ে যান। তখন অনেকে উদাহরণ হিসেবে যুক্তি দেখান, চাচাতো বোনের ছেলে পাঁচ বছর বয়সে কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। এ ভুল ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে এসে বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে হবে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা ১৮ মাস থেকেই কথা বলতে শুরু করে।’
অটিজম আক্রান্ত শিশুর কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বলেন, ‘অটিজম আক্রান্ত শিশুরা শিখতে পারে না। ওদের ধৈর্য ধরে শেখাতে হয়। অনেকে সহজে পড়ালেখা করতে পারে না। কিন্তু তাদের মেধা আছে। আগে অটিজমকে মেধার সমস্যা মনে করা হতো। আসলে তা নয়। তাদের শেখালে তারা শেখে। তবে ওরা অনেক সময় কোনো বিষয় প্রকাশ করতে পারে না। অনেকে শত চেষ্টা করেও হাতের লেখা সুন্দর করতে পারে না, কেউ কেউ আবার পড়তে পারে না, অনেকে মনে রাখতে পারে না।’
‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অনাগ্রহ এক ধরনের অনীহা। আবার অনেকে মাঝপথে কাজ ছেড়ে দেন। এটিও একটি অটিজম। অনেকের চেহারা চায়নিজদের মতো হয়। এটিও একটি অটিজম। কিন্তু অনেকেই এ জন্য এসব শিশুর মা অন্যের সঙ্গে মিশেছে বলে অপবাদ দেয়। এটি একটি ভুল ধারণা। অনেক অটিজম আক্রান্ত শিশুর অতিরিক্ত শব্দ ও আলো ভালো লাগে না। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে’, যোগ করেন অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া সমাপনী বক্তব্য দেন। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. মো. মোজাম্মেল হোসেন বক্তব্য দেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কর্মশালাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কর্মশালার মাধ্যমে সংসদ সদস্যরা বিষয়টি আরো গভীরভাবে জানার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশে এই বিষয়ে পর্যাপ্ত আইন রয়েছে, এসব আইনের আরো কার্যকর পরিবর্তন রয়েছে কি না, সে বিষয়েও ধারণা বের হয়ে আসবে।’
স্পিকার আরো বলেন, জনপ্রতিনিধিরা জনগণের খুব কাছাকাছি অবস্থান করেন। তাই এই কর্মশালায় লব্ধ জ্ঞান তাঁরা ভবিষ্যতে জনগণের কাছে সহজেই পৌঁছে দিতে পারবেন। এরই মধ্যে এ দেশে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে ব্যাপক জনসচেনতা সৃষ্টি হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
কর্মশালায় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজসহ হুইপ, সংসদ সদস্যরা অংশ নেন। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আশরাফুল মকবুল স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের উদ্দেশে বলেন, ‘ছোট্ট সেই মেয়েটি কখন যে এত বড় হলো, এত জ্ঞান অর্জন করল বুঝতেই পারিনি। কবে যে এত বড় হলো, এত জ্ঞান অর্জন করল, এত বড় বিশেষজ্ঞ হলো। সত্যি যোগ্য মায়ের যোগ্য কন্যা। তাঁর বক্তব্য আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।’
রওশন এরশাদ বলেন, এ দেশে ১৬ কোটি ২৬ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি ২০ লাখ প্রতিবন্ধী আছে। প্রতিবন্ধী মায়েরা সমাজে বিশেষভাবে উপেক্ষিত। প্রতিবন্ধী শিশুদের ঘর থেকে বের না করার ফলে তারা সমাজ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে রওশন এরশাদ বলেন, ‘এ বিশাল দায়িত্ব সবাই যদি ভাগ করে নেওয়া যায়, তাহলে আমরা সাফল্য লাভ করতে পারব।’
অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সূচনা ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ডা. মো. গোলাম রাব্বানী আলোচনায় অংশ নেন।