ওসি প্রদীপ-লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড থাকবে কিনা হাইকোর্টের রায় ২ জুন
কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার মামলার ডেথ রেফারেন্স ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও চারজনের বিরুদ্ধে বাদির রিভিশন মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ২ জুন এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন হাইকোর্ট।
আজ বৃহস্পতিবার (২৯ মে) বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ শুনানি শেষে এ রায়ের এ দিন ধার্য করেন।
এ মামলায় আসামিপক্ষে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, এস এম শাহজাহানসহ কয়েকজন আইনজীবী শুনানি করেন। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসিম সরকার, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল গিয়াস উদ্দিন, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সুমাইয়া বিনতে আজিজ প্রমুখ।
এ বিষয়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সুমাইয়া বিনতে আজিজ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে টানা শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এ মামলার। রাষ্ট্রপক্ষে আমরা আসামিদের অপরাধের বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছি। প্রত্যেক আসামির অপরাধ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি বহালের দাবি জানিয়েছি। আগামী ২ জুন মামলাটি রায়ের জন্য কার্যতালিকায় এক নম্বর আইটেম হিসেবে থাকবে।
বিচারিক আদালত এ মামলায় দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, তারা হলেন–টেকনাফ থানার বরখাস্ত সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী।
আটজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারা হলেন- বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মা এবং পুলিশের সাক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শামলাপুরের তিন বাসিন্দা নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান আদালতে আসামিদের শাস্তি বহাল রাখার জন্য আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, কক্সবাজার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত। এখানে দেশের মতো বিদেশি পর্যটকরাও ঘুরতে যায়। তাই এলাকাকে নিরাপদ জোন করা জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলো পুলিশের দ্বারা একজন নিরস্ত্র চৌকস সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার মেজর সিনহাকে জুডিসিয়াল কিলিং করে। ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ওসি প্রদীপ কক্সবাজার এলাকায় অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালানের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তার অপকর্মগুলো প্রকাশের ভয়ে তারা মূলত এ হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়।
নিরস্ত্র সাবেক সেনা কর্মকর্তা যদি হত্যার শিকার হয় তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? এ কারণে সাবেক ওসি প্রদীপ এবং এস আই লিয়াকতসহ সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করছি।
অপরদিকে মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রদীপের পক্ষে মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ওসি প্রদীপ পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এটি করেনি। গুলি করেছে লিয়াকত আলী। গুলির পর ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে আসে। জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ বলেন, ওসি প্রদীপ লাথি মেরে বুকের দুটি হাড় ভেঙ্গেছে এটি তদন্তে প্রমাণিত। এছাড়া ঘাড়ে লাথি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে সেটির প্রমাণ মিলেছে।
অপরদিকে লিয়াকতের পক্ষে আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, এটি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। বরং লিয়াকত পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বে ছিল। ডাকাত সন্দেহে সে মেজর সিনহাকে গুলি করেছে। এটি একটি দুর্ঘটনা। যেহেতু পূর্ব পরিকল্পিত নয় তাই এটির সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে না। আমরা খালাস চাই। এ ছাড়া আটজন যাবজ্জীবন প্রাপ্ত আসামিদের পক্ষে খালাস চেয়ে যুক্তি তুলে ধরেন আসামিদের আইনজীবীরা।
মামলার চার্জশিটে মেজর সিনহা হত্যার বীভৎস বর্ণনা
রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সুমাইয়া বিনতে আজিজ মামলার চার্জশিট অনুযায়ী মেজর সিনহার হত্যার বর্ণনা পড়ে আদালতকে বলেন, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সিনহা মো. রাশেদ খান তাঁর সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে প্রতিদিনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ভিডিও ধারণ করার জন্য টেকনাফের মারিশবুনিয়ার মুইন্ন্যা পাহাড়ের উদ্দেশে প্রাইভেটকারযোগে রওনা দেন। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নতুন মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে গাড়িটি পার্ক করে তাঁরা পাহাড়ের দিকে রওনা হন। তাঁর পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোশাকের মতো কমব্যাট প্যান্ট ও কমব্যাট গেঞ্জি এবং সঙ্গে ছিল ভিডিও ধারণের ক্যামেরা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
পাহাড়ে ওঠার সময় মারিশবুনিয়ার মাথাভাঙ্গা জামে মসজিদের ইমামের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদের সালাম বিনিময় হয়। পথে একটি ছোট ছেলের কাছ থেকে তাঁরা পাহাড়ে ওঠার পথও জেনে নেন। এরপর তাঁরা ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করার জন্য মুইন্ন্যা পাহাড়ে ওঠেন। পরে পাহাড় ও সমুদ্রের চিত্র ধারণ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে। এর মধ্যে পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াজ লোক মারফত জানতে পারেন, মুইন্ন্যা পাহাড়ে ভিডিও ধারণের জন্য দুজন লোক উঠেছে। তাঁরা আরও জানতে পারেন, তাঁদের একজন সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত এবং তাঁদের সঙ্গে ক্যামেরা আছে। এতে তাঁরা নিশ্চিত হন, এরাই সেই ভিডিও পার্টি, যাদের খুঁজে বের করার জন্য ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী তাঁদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন।
এরপর রাত ৮টার দিকে নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলীর পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী ডাকাত সাব্যস্ত করে গণপিটুনি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। সেজন্য দক্ষিণ মারিশবুনিয়া জামে মসজিদের মাইকে তাঁরা ঘোষণা করেন, পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে। তখন কিছু লোক জড়ো হয়। কিন্তু পাহাড়ে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় লোকজনের কাছে তাঁরা ডাকাতির বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এরপরও দমে যাননি নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ। তাঁরা মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমাম হাফেজ জহিরুল ইসলামকে দিয়ে মাইকে অনুরূপ ঘোষণা দেওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হাফেজ জহিরুল ইসলাম উপস্থিত লোকজনদের বলেন, উক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ সিনহা মো. রাশেদ খান ডাকাত নন, আর্মির লোক। পাহাড়ে ওঠার আগে তাঁর সঙ্গে মেজর সাহেবের দেখা হয়েছে এবং সালাম বিনিময় হয়েছে। এ কথা বলায় লোকজন চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পর সিনহা মো. রাশেদ ও সিফাত পাহাড় থেকে আইয়াজ, নুরুল আমিন ও নিজাম উদ্দিনের সামনে দিয়ে নেমে যান। সে সময় নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ তাঁদের হাতে থাকা টর্চ লাইটের আলো ফেলে নিশ্চিত হন, এরাই সেই ভিডিও দল।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, এই তিন আসামি নুরুল আমিন, আইয়াজ ও নিজাম উদ্দিন সিনহা মো. রাশেদকে অনুসরণ করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যন্ত যান এবং তাঁরা কোন দিকে যাচ্ছেন, তা নিশ্চিত হন। সিনহা মো. রাশেদ তাঁরা নিজস্ব প্রাইভেটকার চালিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন—এ তথ্যটি আসামি নুরুল আমিন রাত ৮টা ৪৭ মিনিটে পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মোবাইল ফোনে জানান। এ ছাড়াও রাত ৮টা ৪৭ মিনিট থেকে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে নুরুল আমিন ও লিয়াকত আলীর ১৪/১৫ বার মোবাইলে কথোপকথন হয়। নুরুল আমিনের ফোন পেয়ে লিয়াকত আলী তড়িঘড়ি করে সঙ্গে কোনো ফোর্স না নিয়ে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ একটি মোটরসাইকেলে করে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে হাজির হয়ে সশস্ত্র অবস্থান নেন। তাঁরা সিনহা মো. রাশেদের গাড়িটি সেখানে আসার অপেক্ষায় থাকেন।
অভিযোগপত্রের ১৩ পাতায় তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে বিজিবি চেকপোস্ট অতিক্রম করে। এরপর রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে গাড়িটি শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছালে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্য রাজীব গাড়িটি থামার সংকেত দিলে তাঁরা গাড়িটি থামান। তখন রাজীব পরিচয় জানতে চাইলে গাড়ির বাঁ পাশের আসনে বসা সিফাত গাড়ির জানালা খুলে দেন। এ সময় ড্রাইভিং সিটে বসা সিনহা মো. রাশেদ নিজের পরিচয় দেন। তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর রাজীব এবং অন্য দুজন সদস্য এসআই শাহজাহান আলী ও আবদুল্লাহ আল মামুন ওরফে ইমন স্যালুট দিয়ে গাড়িটিকে চলে যাওয়ার সংকেত দেন।
সিনহা তখন গাড়িটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। হঠাৎ সিনহার নাম শুনেই লিয়াকত আলী চিৎকার করে গাড়িটির সামনে চলে যান এবং আবার তাঁদের পরিচয় জানতে চান। পুনরায় মেজর (অব.) সিনহা নিজের পরিচয় দেন। তখন লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে আবার ব্যারিকেড তুলে রাস্তা বন্ধ করে দেন। এ কাজে এসআই নন্দ দুলালও সহযোগিতা করেন। এরপর লিয়াকত আলী পিস্তল তাক করে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সিনহা মো. রাশেদকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং গাড়ির সব যাত্রীকে দুহাত ওপরে তুলে নেমে আসতে বলেন। হঠাৎ তাঁর চিৎকারে রাস্তার দুই পাশে চলাচল করতে থাকা লোকজনও হকচকিত হয়ে যায় এবং ঘটনাস্থলে কী হচ্ছে, তা দেখার জন্য পথচারীরা দাঁড়িয়ে যান। এই চেকপোস্টটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সেখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার লাইট দিয়ে আলোকিত করা ছিল এবং এতে আশপাশের মসজিদ, বাজার ও রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন পরিষ্কারভাবে সব কিছু দেখতে পেত।
অভিযোগপত্রের ১৪ পাতার প্রথম অনুচ্ছেদে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ওই সময় লিয়াকত আলী উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। তখন গাড়ির ২ নম্বর আসনে বসা সাহেদুল ইসলাম সিফাত দুহাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন। ড্রাইভিং সিটে বসা মেজর (অব.) সিনহাও দুহাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে কামডাউন, কামডাউন বলেন এবং লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
লিয়াকত আলী মেজর (অব.) সিনহার পরিচয় জেনে তাঁর কোনো কথা না শুনে এবং কোনো ধরনের সময় না দিয়ে তাঁকে লক্ষ্য করে প্রথমে দুই রাউন্ড গুলি করেন এবং কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন। এতে সিনহা মো. রাশেদ রাস্তায় পড়ে যান। গুলি করার পর লিয়াকত আলী মেজর (অব.) সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পড়ানোর নির্দেশ দেন। তখন এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত আহত সিনহাকে হাতকড়া পরান। কিন্তু, এসআই শাহাজাহান আলীর কাছে হাতকড়া না থাকায় লিয়াকত তাঁকে গালমন্দ করেন এবং রশি এনে সিফাতকে বাঁধতে বলেন। তখন কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে ইমন পাশের শামলাপুর বাজারের দোকান থেকে রশি এনে এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল রাজিবের সহযোগিতায় সিফাতকে রশি দিয়ে বাঁধেন।
ঘটনার পর লিয়াকত আলী মোবাইল ফোনে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে এক মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথা বলেন এবং তিনি ওসি প্রদীপকে ঘটনাটি জানান। এর কিছুক্ষণ পর রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে লিয়াকত আলী ঘটনাটি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে (এসপি) জানান। সিনহা মো. রাশেদ তখনও জীবিত ও সজাগ ছিলেন এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে সিনহা একটু পানি খাওয়ার জন্য আকুতি-মিনতি করেন। এটা শুনে এবং তাঁকে তখনও জীবিত অবস্থায় দেখে লিয়াকত আলী আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তিনি সিনহাকে বলেন, তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য? এরপর লিয়াকত আহত সিনহার কাছে যান এবং বুকের বাঁ পাশে জোরে কয়েকটি লাথি মারেন এবং পা দিয়ে বুক চেপে ধরেন। এরমধ্যে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে কিছু পুলিশ পাঠাতে বলেন।
নন্দ দুলাল রক্ষিতের ফোন পেয়ে তদন্ত কেন্দ্র থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এএসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, ছাফানুল করিম ও কামাল হোসেন আজাদ সিএনজিতে করে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর লিয়াকত আলী এপিবিএন সদস্য এসআই লিটন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, কামাল হোসেন আজাদ ও ছাফানুল করিমকে সিনহা মো. রাশেদের গাড়িটি তল্লাশি করতে বলেন। তাঁরা গাড়ির ভেতরে সামনের দুই সিটের মাঝখান থেকে একটি অস্ত্র, ড্যাসবোর্ডে কিছু কাগজপত্র, ক্যামেরা, সিডিবক্স ও ভিডিও করার যন্ত্রপাতি পান। তখন সেখানে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি। পুরো ঘটনাটি রাস্তার দুপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী, পথচারী, মসজিদ, বাজার ও জেলেঘাটের লোকজন চেকপোস্টের পরিষ্কার আলোয় প্রত্যক্ষ করেন। সেদিন চাঁদ রাত হওয়ায় সেখানে লোক সমাগমও বেশি ছিল।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, লিয়াকত আলীর সফলতার ফোন পেয়ে ওসি প্রদীপ একটি সাদা মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপভ্যানে তাঁর সঙ্গীয় ফোর্সসহ দ্রুতগতিতে রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এরপর প্রদীপ ও লিয়াকত আলী একান্তে কিছু সময় আলাপ করেন। তারপর প্রদীপ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা সিনহার কাছে যান। তখন প্রদীপ দম্ভোক্তি করে বলেন, অনেক টার্গেট নেওয়ার পর কুত্তার বাচ্চারে শেষ করতে পারছি। তারপর প্রদীপ প্রথমে সিনহাকে পা দিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখেন। সিনহা তখনও জীবিত ছিলেন এবং পানি চাচ্ছিলেন। প্রদীপ তখন তাঁর পায়ের জুতা দিয়ে সিনহার গলা চেপে ধরেন এবং এক পর্যায়ে সিনহার শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখনও প্রদীপ, লিয়াকত এবং সঙ্গীয় ফোর্সের কেউই সিনহার পড়ে থাকা দেহটিকে হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ না নিয়ে ঘটনাস্থলে ফেলে রাখেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ওসি প্রদীপ তাঁর সঙ্গীয় ফোর্সের মাধ্যমে মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি পুনরায় তল্লাশি করে মাদক খুঁজে বের করতে বলেন। তাঁর সঙ্গে আসা টেকনাফ থানার সাগর দেব ও রুবেল শর্মা নিজেদের বহনকারী মাইক্রোবাসের দিকে যান এবং এর কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে চিৎকার করে বলেন, সিনহার গাড়ির ভেতর মাদক পাওয়া গেছে।
এতপর ওসি প্রদীপের নির্দেশে তাঁর সঙ্গীয় ফোর্স সিনহার সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের হাত বেঁধে চেকপোস্টের ভেতরে নিয়ে যান। সেখানে তাঁরা তাঁর মুখের ওপর পানি ঢেলে অবর্ণনীয় কায়দায় নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময়ের সব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সিনহা মো. রাশেদকে হাসপাতালে নেওয়ার কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রায় সোয়া ঘণ্টা বিলম্ব করা হয়েছে। সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী অস্বাভাবিক দেরিতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। পরে এএসআই লিটন, কনস্টেবল কামাল হোসেন আজাদ ও সাফানুল করিম মেজর (অব.) সিনহাকে একটি পিকআপে তুলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে যত চেষ্টা
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সিনহা কিছুক্ষণ পর মামলার অন্যতম সাক্ষী সার্জেন্ট মো. আইউব আলী আর্মি সিকিউরিটি ইউনিট (এএসইউ) রামু ক্যান্টনমেন্ট শামলাপুর আর্মি আরপি চেকপোস্টে থাকা অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন। তখন তিনি ঘটনাস্থল শামলাপুর চেকপোস্টে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ অন্যরা ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছেন। সার্জেন্ট আইউব আলী ঘটনাস্থলে গিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে চিনতে পেরে এবং তাঁকে গুরুতর জখম অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইলে সিনহার ছবি তোলেন। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা সার্জেন্ট আইউব আলীর পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাঁর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দেন। খবর পেয়ে রামু ক্যান্টনমেন্টের লেফটেন্যান্ট মুনতাছির আরেফিন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে উপস্থিত হন। তাঁর সঙ্গে সার্জেন্ট আইউব আলী তদন্ত কেন্দ্রের ভেতরে ঢোকেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে ওসি প্রদীপ উচ্চস্বরে কথা বলেন ও দুর্ব্যবহার করেন।
ঘটনার পর রামু সেনানিবাস থেকে সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যরা এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে উপস্থিত হন। সেখানে তাঁরা মেজর (অব.) সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ওসি প্রদীপসহ স্থানীয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। এরপরও ওসি প্রদীপ সিনহার পরিচয় সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে ঢাকায় অবস্থানরত তাঁর মাকে ফোন করেন এবং তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হন। তবে, সিনহার হত্যার ঘটনাটি তাঁর মায়ের কাছে গোপন করেন ওসি প্রদীপ। শুধু তাই নয়, হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সিনহা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে তিনটি বানোয়াট মামলা দায়ের করেন। এরপর প্রদীপের নির্দেশে সিনহার সহযোগী সিফাতকে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়া হয়। তাঁদের অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে রামু থানাধীন নিলীমা রিসোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁদের ভিডিও তৈরির কাজে ব্যবহৃত ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ একাধিক জিনিসপত্র জব্দ করা হয়। এসব যন্ত্রপাতি থানায় নিয়ে তাঁদের শ্যুট করা সব ভিডিও আলামত নষ্ট করা হয়।
এর আগে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য এই বেঞ্চে পাঠানো হয়।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত রায় দেন।
রায়ে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড, ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাতজনকে খালাস দেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন– বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন– বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মা এবং পুলিশের সাক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শামলাপুরের তিন বাসিন্দা নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
আইন অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের রায় অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি দণ্ডিত আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করেন।
কে এই সিনহা মো. রাশেদ?
মামলার অভিযোগপত্র ও পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, সিনহা মো. রাশেদ খানের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পূর্ব ইউনিয়নের মানিকরাজ গ্রামে। তাঁর বাবা এরশাদ খান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সর্বশেষ তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সিনহা ছিলেন মেঝ।
অভিযোগপত্রের ১২ নম্বর পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে জন্মগ্রহণ করেন সিনহা মো. রাশেদ খান। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় পড়াশোনা করতে হয়েছে তাঁকে। পরে ১৯৯৯ সালে রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ২০০১ সালে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। ২০০৩ সালের ২১ জানুয়ারি ৫১তম বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন সিনহা। ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশনপ্রাপ্ত হন তিনি।
মেধাবী এ সেনা কর্মকর্তার শিক্ষাজীবন ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ ২০০৪ সালে প্রথম শ্রেণিতে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। চাকরিজীবনে তিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীন যোদ্ধা (আন্ত-ইউনিট সঙ্গীন যুদ্ধ প্রতিযোগিতা ২০০৭), আন্ত-ইউনিট বেয়নেট ফাইটিং প্রতিযোগিতা ২০০৭-এর শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগী ছিলেন। তিনি ক্যাপ্টেন পদে ২০০৯ সালে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেস প্রটেকশন কোর্স-৫০ সম্পন্ন করেন। ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ১৩ মে পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ‘ভিআইপি প্রটেকশন কোর্স’ সম্পন্ন করেন।
সিনহা মো. রাশেদ খান ২০০৯ সালের ৪ জুলাই থেকে ২০১২ সালের ২ নভেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্য হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আইভোরি কোস্টে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিক্স (এসআইঅ্যান্ডটি) থেকে বিপিসি-১৯ কোর্স শেষ করেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার, সাভার থেকে ‘সিভিল-মিলিটারি রিলেশন অ্যান্ড গুড গভর্ন্যান্স সার্টিফিকেট’ অর্জন করেন। ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে ‘ওয়ার্কশপ অব ডিজাস্টার অ্যান্ড হিউম্যান সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট’ সার্টিফিকেট অর্জন করেন। পরবর্তীকালে ২০১৬ সালে ডিএসসিএসসি থেকে ‘মাস্টার অব সায়েন্স ইন মিলিটারি স্টাডি’ এবং ১২ এপ্রিল ২০১৫ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সাল (২০১৫-২০১৬) পর্যন্ত ‘পিএসসি’ কোর্স সফলতার সঙ্গে শেষ করেন। ২০১৯ সালে তিনি মেজর পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। চাকরিজীবনে তিনি রামু সেনানিবাস, টেকনাফ বিজিবি ও ব্যাটালিয়নে দায়িত্ব পালন করেন।
কেন ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন সিনহা?
সিনহা মো. রাশেদের অবসর-পরবর্তী জীবনের কথা উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, তিনি বিভিন্ন শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক এবং ভ্রমণ ও পর্যটন বিষয়ে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘JUST GO’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ চ্যানেলের ডকুমেন্টারি কনটেন্ট তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ভিডিওচিত্র ধারণ করতেন। এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য নিরলস কাজ করছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সিনহা মো. রাশেদ তাঁর সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাত, তাহসিন নুর রুপ্তি, শিপ্রা দেবনাথসহ মোট চার জন ২০২০ সালের ৩ জুলাই ভিডিওচিত্র ধারণ করার করার কাজে কক্সবাজারে আসেন এবং হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন।