দেড় কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ কাজের জন্য জনদুর্ভোগ চরমে

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর থেকে পাবনার ঈশ্বরদী পর্যন্ত রাস্তা প্রশস্তকরণকাজ চলতি অর্থবছরেও শেষ না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে কাজের মেয়াদ বাড়ানো না হলে ৫৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৫৪ কিলোমিটার সড়কটিতে জনদুর্ভোগ পৌঁছাবে চরমে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির চারঘাট ও বাঘাবাজার ছাড়া প্রশস্তকরণ কাজ শেষ হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। চারঘাট ও বাঘা উপজেলা সদরের বাজার এলাকার দেড় কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত, ড্রেন নির্মাণ ও আলোকায়ন কাজ বন্ধ থাকায় সড়কটিতে চলাচলকারী হাজার হাজার যানবাহন এবং এলাকাবাসী প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছে। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
এই সড়কে জনদুভোর্গের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে এলে গত ২০ মার্চ সড়ক বিভাগ প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে চারঘাট ও বাঘা উপজেলা সদরের দেড় কিলোমিটার আরসিসি ঢালাই সড়ক, ড্রেন নির্মাণ ও আলোকায়নের জন্য শামীম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে।
চুক্তি অনুযায়ী ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিন থেকে কাজ শুরু করলেও পদে পদে বিপত্তিতে পড়তে হয় ঠিকাদারকে। দেড় কিলোমিটার সড়কের জমি অধিগ্রহণ জটিলতা, কাজ শুরুর পর থেকে টানা বৃষ্টি, অধিগ্রহণকরা জমির মালিকদের অনেকে টাকা বুঝে না পাওয়ায় কাজ করতে বাধা দেওয়া, সড়কের বিদুৎ লাইন এখন পর্যন্ত না সরানোয় চারঘাট ও বাঘাবাজারের সড়ক নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয় বলে সড়ক বিভাগকে লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শামীম এন্টারপ্রাইজ।
সরেজিমন ঘুরে দেখা গেছে, একপাশে রাস্তা বন্ধ করে সড়কে ঢালাইয়ের কাজ চলছে। বৃষ্টির কারণে গর্তে পানি জমে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়ছে ব্যস্ততম এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী হাজার হাজার যানবাহন ও পথচারী। মাত্র ৫ মিনিটের সড়ক পার হতে কখনও কখনও সময় লাগছে এক থেকে দুই ঘণ্টা। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা।
চারঘাট বাজার এলাকায় সড়কটির জন্য অধিগ্রহণ করা জমির মালিক নয়ন ইসলাম, আহসান হাবিব, আব্দুর রাজ্জাক, কোরবান আলীসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, তারা এখন পর্যন্ত অধিগ্রহণের টাকা পাননি। কবে পাবেন, সে বিষয়েও কিছু জানেন না। তারা প্রথমে ঠিকাদারকে কাজ করতে বাধা দিলেও এলাকার বৃহত্তর স্বার্থে ঠিকাদারকে কাজ করতে দিচ্ছেন।
চারঘাট বাজারের মুরাদ পাশা বলেন, আমাদের এই বাজারটি নিজস্ব জায়গায়। সড়ক প্রশস্ত করার জন্য তাদের যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী সেই জমির টাকা পাননি। তাই তারা ঈদের আগে আর কাজ করতে দিবেন না। প্রয়োজনে তারা আন্দোলন করবেন। তিনি বলেন, এখন জনগণই তো সরকার। রাস্তাটি আমাদের অনেক ভোগান্তিতে ফেলেছে। আমরাও চাই দ্রুত কাজটি শেষে হবে। কাজ শুরুও হয়েছে। কিন্তু জমির দাম না পাওয়ায় অনেক জমির মালিক কাজ করতে দিচ্ছেন না। আমরা রাস্তার কাজ শেষ হওয়ার আগেই আমাদের জমির ক্ষতিপূরণের টাকা চাই।
অপরদিকে বাঘাবাজারের এনামুল হক ঝন্টু, শাহিন আলী ও ইমদাদুল হকসহ একাধিক জমির মালিকের দাবি, বাঘাতে বেশিরভাগ জমির মালিক এখনও টাকা পাননি। ফলে এ সড়কের কাজ কীভাবে শুরু হবে?
বাঘাবাজারের বাসিন্দা সিফাত আলী বলেন, এই বাজারে আগে-পরে সবখানেই ভালো রাস্তা। শুধু বাজার এলাকার রাস্তাটিই খারাপ। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে। গর্ত হয়। গাড়ি উল্টে যায়। আমরা কোনো রকমে এখান দিয়ে চলাচল করি। এরপর এখানে দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ব্যাপার।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজটির তত্ত্বাবধান করছেন আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল। তিনি জানান, ২০ মার্চ চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিন থেকেই আমরা রাস্তার কাজ শুরু করেছি। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই আমরা সড়ক বিভাগকে জানিয়েছি, এত স্বল্প সময়ের মধ্যে দেড় কিলোমিটার ঢালাই সড়ক নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। যদিও সড়ক বিভাগ আমাদের পুরো সড়ক এখনও বুঝিয়ে দিতে পারেনি। বিদ্যুতের খুঁটি রাস্তা থেকে এখনও সরানো হয়নি। জমির মালিকরা অধিগ্রহণের টাকা না পাওয়ায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এর পরও এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করতে পারার যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করে সময় বাড়ানোর জন্য আমরা সড়ক বিভাগে আবেদন করেছি। এখন সময় বাড়ানো হবে কি না, তা নির্ভর করছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের উপর।
সড়ক বিভাগে দেওয়া চিঠিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লিখেছে, ৩১ ডিসেম্বর টেন্ডার আহ্বান করার পর আমার প্রতিষ্ঠানকে ১২ মার্চ ২০২৫ তারিখে এনওসি ইস্যু করা হয়। যদিও টেন্ডারে কাজ সম্পন্ন করার জন্য ১২ (বারো) মাস সময় উল্লেখ ছিল। আমাকে কাজ সম্পন্ন করার জন্য ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময় দিয়ে চুক্তিপত্র করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য আজ অবধি আমরা সাইট বুঝে পাইনি। কাজের জায়গায় স্থাপনা, বিদ্যুতের পোল এখনও বিদ্যমান। তার পরও আমরা কাজটি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে কাজের প্রয়োজনে ব্যবহৃত সব যন্ত্রপাতি, মালামাল প্রস্তুত করেছি এবং কাজ শুরু করেছি। ৩০ জুন বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব না।
ঠিকাদার আরও লিখেছেন, বর্ষা মৌসুমে কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে দ্রুত সাইট বুঝিয়ে এবং সময় বর্ধিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাজশাহীর রাস্তা উন্নয়ন কাজ করে জনগণের সুন্দরভাবে চলাচল নিশ্চিত এবং যানবাহন চালাচলের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করছি।
জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল বলেন, পুরো রাস্তা বুঝে না পাওয়া, লাগাতার বৃষ্টি ও সড়ক বন্ধ করে কাজ করতে না পারায় বিড়ম্বনার সৃষ্টি হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। আমরা সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি। সড়ক বিভাগ এখনও কোনো জবাব দেয়নি। ফলে সময় বাড়ছে কি না, সেটি আমরা বুঝতে পারছি না।
সড়ক ও জনপথ রাজশাহী বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সানজিদা আফরীন ঝিনুকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার মুঠোফনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে সড়কটির প্রকল্প পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের এই প্রকল্পটি আগামী জুনেই শেষ হবে। এটির মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না, তা সরকারের উপর নির্ভর করছে। তবে সড়টির কাজ চলছে। যদি সময় না বাড়ে, তাহলে আমরা আমাদের অন্য একটি এমটিও প্রকল্পের মাধ্যমে কাজটি শেষ করাব।
হাফিজুর রহমান আরও বলেন, জমি অধিগ্রহণের টাকা আমরা এক বছর আগেই জেলা প্রশাসক অফিসে দিয়ে দিয়েছি। যারা টাকা পায়নি, তাদের হয়তো কোনো সমস্যা আছে। সেটি ডিসি অফিস বলতে পারবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ভূমি অধিগ্রহণ শাখা) মানজুরা মুশাররফ বলেন, নির্দিষ্ট কাগজের কারণেই কিছু কিছু জমির মালিক টাকা দাবি করতে পারছে না। তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করলে টাকা পেয়ে যাবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে আমরা ভূমি অধিগ্রহণ করে ফেলেছি।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর থেকে চারঘাট-বাঘা-নাটোরের লালপুর হয়ে পাবনার ঈশ্বরদী পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার সড়ক ১৮ ফুট থেকে প্রশস্ত হয়ে ৩৪ ফুট হচ্ছে। সড়কের প্রশস্তকরণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তবে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় আরও এক বছর সময় বাড়িয়ে কাজ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এখন চারঘাট ও বাঘা বাজারের দেড় কিলোমিটারের কাজ শেষ হলে সড়কটি নির্বিঘ্ন চলাচলের উপযোগী হবে।