গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য গ্রাম!

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হবিবপুর গ্রাম গ্রেপ্তার আতঙ্ক, পুলিশি হয়রানি এবং প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে গত কয়েকদিন ধরে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এর আগে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। গ্রামের দুটি বাজারে দোকানপাট বন্ধ রেখে লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কে দিন কাটছে গ্রামের নারী ও শিশুদের।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনার প্রত্যন্ত পল্লী পূর্বধলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের হবিবপুর গ্রামের বশির মিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন পার্শ্ববর্তী পাইলাটী গ্রামের মো. জুয়েল মিয়ার বিরোধ চলছিল। এরই মধ্যে জুয়েল মিয়ার মেয়েকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেয় বশির মিয়ার ছেলে আরিফ। জুয়েল মিয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে গত ৯ জুন জুয়েল মিয়া মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেন। এতে করে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ আরও বেড়ে যায়।
এরই জের ধরে গত ১২ জুন রাতে জুয়েল মিয়ার বাড়ির পাশে রাস্তায় দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে জুয়েল মিয়ার লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হবিবপুরের দিকে যেতে থাকে। অপরদিকে হবিবপুর গ্রামবাসী জড়ো হয়ে তাদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে শ্যামগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের কয়েকজন পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ওইদিন রাত ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এরই মধ্যে জুয়েল মিয়ার গোয়াল ঘরে আগুন লেগে পুড়ে যায়। সংঘর্ষে পুলিশ সদস্য আনসার আলী, হুমায়ুন কবীর, উত্তম কুমার ভাট, হুমায়ুন কবিরসহ উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়।
পরে খবর পেয়ে পূর্বধলা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এরই মধ্যে জুয়েল মিয়ার বাড়ি, নারান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মশিউর রহমান সেলিম, রশিদ মিয়ার বাড়িসহ হবিবপুর গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়িতে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ঘরের দরজা-জানালা, ফ্রিজ, আলমিরা, থালা, রান্নাঘরের চুলা, বাসনসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং বিছানাপত্র এলোমেলো করে ফেলে রেখে যায়।
এ ঘটনায় শ্যামগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এস আই) উত্তম কুমার ভাট বাদী হয়ে স্থানীয় নারান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মশিউর রহমান সেলিম, আরিফ, ইসলাম উদ্দিন, হাসিম উদ্দিন, নওশাদ, আশিক, রুবেল, সুমনসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৮০ থেকে ৯০ জনকে আসামি করে গত ১৩ নভেম্বর (প্রদত্ত তারিখ, সম্ভবত জুনের বদলে) পূর্বধলা থানায় মামলা করেন।
অন্যদিকে একই দিন মো. জুয়েল মিয়া বাদী হয়ে আরিফ, ইসলাম উদ্দিন, বশির মিয়া, নারান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মশিউর রহমান সেলিমসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করে পূর্বধলা থানায় মামলা করেন। পুলিশ মামলার আসামি রহিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।
এরপর গ্রেপ্তার আতঙ্কে গ্রামের পুরুষ লোকজন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মামলা করার পর থেকে গ্রামের দুটি বাজারে বিভিন্ন পণ্যের অর্ধশত দোকান বন্ধ রয়েছে। এতে করে ওই সমস্ত দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে পুরুষ মানুষ না থাকায় পরিবারের নারী ও শিশুরা কষ্ট করে দিনযাপন করছেন। অনেকের বাড়িতে বাজার করার মতো কেউ নেই। তাদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে একাধিক নারী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ‘মারামারি হয়েছে ঠিকই। এতে পুলিশসহ দুই পক্ষের লোকই আহত হয়েছে। তাই বলে সবাইতো মারামারি করেনি। এখন পুলিশ ও জুয়েল মিয়ার লোকজন রাতের বেলা আমাদের বাড়িতে হানা দেয়। আমরা শান্তিতে ঘুমাইতে পারি না। আমরাও চাই যারা দোষ করেছে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার এবং বিচার করুক। কিন্তু অজ্ঞাত আসামি দিয়ে আমাদের লোকজনকে গ্রেপ্তার করবে এটা আমরা চাই না। আমরা নিরীহ গ্রামবাসী শান্তিতে থাকতে চাই।’
এ বিষয়ে মো. জুয়েল মিয়া বলেন, ‘আরিফ ও তার লোকজন আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। আমাদের লোকজনকে মারধর করেছে। পুলিশকেও মারধর করেছে। আমরা তাদের ওপর হামলা করিনি।’
পূর্বধলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নূরুল আলম বলেন, ‘দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ থামাতে গেলে গ্রামের লোকজন পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে কয়েকজন পুলিশ আহত হয়। মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। অহেতুক কাউকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা হবে না। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।’