বাংলাদেশের জাতির পিতা একজন নয় : নাহিদ ইসলাম
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা মাওলানা ভাসানীকে বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি, বাংলাদেশের অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার্স মনে করি। বাংলাদেশের কোনো একজন জাতির পিতা নয়, বাংলাদেশে অনেকজন জাতির পিতা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম রয়েছেন মাওলানা ভাসানী।’
আজ মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) দুপুরে এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রার’ অংশ হিসেবে টাঙ্গাইল শহরের নিরালা মোড়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে নাহিদ ইসলাম এসব কথা বলেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘টাঙ্গাইলের এলে যে কথা সবার আগে বলতে হয়, তিনি হলেন মেহনতি মানুষের নেতা, গণমানুষের নেতা মাওলানা হামিদ খান ভাসানী। ভাসানী শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশের একজন অনন্য রাজনৈতিক পুরুষ ছিলেন। ভাসানীর রাজনীতি শুরু হয়েছিল সেই আসামে। সেই আসামে বাঙালি মুসলমান কৃষকদের ভূমির অধিকারের জন্য, জমির অধিকারের জন্য, কৃষকদের জন্য লড়াই তিনি লড়াই করেছিলেন। যে লড়াই এখনও পর্যন্ত আসামের বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের লড়তে হয়। পরিচয়ের জন্য তাদেরকে লড়াই করতে হয়। মাওলানা ভাসানী যে লড়াই আসামে শুরু করেছিলেন, যে লড়াই শুরু করেছিলেন এই টাঙ্গাইলে, যে লড়াই শুরু করেছিলেন এই পূর্ববঙ্গে, সেই লড়াই আজও প্রাসঙ্গিক।’
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ‘মাওলানা ভাসানী প্রথম ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিদায় ঘোষণা করেছিলেন কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে। তিনিই প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তি যিনি বুঝেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের থাকা সম্ভব নয়। মাওলানা ভাসানী ছিলেন এমন রাজনীতিক, যিনি স্বাধীনতার পরে বলেছিলেন –আমরা পিণ্ডির জিঞ্জির ভেঙেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়। দিল্লির গোলামি করার জন্য নয়। তিনি একাধারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, পিণ্ডির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, মাওলানা ভাসানী আমাদের ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের পানি অধিকারের জন্য লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন মাওলানা ভাসানী।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা আজকে এই সমাবেশ থেকে মাওলানা ভাসানীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই। আপনারা জানেন, মাওলানা ভাসানীকে ইতিহাসে স্মরণ করা হয় না। সারজিস আলম বলেছেন, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানীর মতো মহান রাজনৈতিক পুরুষ, যারা এই বাংলাদেশের স্থপতি, তাদেরকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জাতির পিতা শুধু একজন ব্যক্তিকে ঘোষণা করা হয়েছে, একজন ব্যক্তিকে পূজা করা হয়েছে গত ৫৪ বছর ধরে। কিন্তু মাওলানা ভাসানীরা না থাকলে শেখ মুজিব কখনো তৈরি হতে পারত না। সেই ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে নিয়েছে, সেই ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম কারিগর ছিলেন, নেপথ্যের পুরুষ ছিলেন মাওলানা ভাসানী।’
এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘মাওলানা ভাসানী কৃষকদের জন্য লড়াই করেছিলেন, শ্রমিকদের জন্য লড়াই করেছিলেন, গণমানুষের জন্য লড়াই করেছিলেন, আমরা মাওলানা ভাসানীর সেই আদর্শকে ধারণ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে চায়। মাওলানা ভাসানী শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক দার্শনিক। তিনি দায়িত্বের রাজনীতির কথা বলেছিলেন। আমাদের প্রাণ, প্রকৃতি, সমাজ এবং আশপাশের মানুষের দায়িত্ব নিতে হবে। সেই দায়িত্ব ও দরদের ভিত্তিতে নতুন সমাজ এবং নতুন দেশ গড়তে হবে। সেই নতুন বাংলাদেশের কথাই জাতীয় নাগরিক পার্টি বলে যাচ্ছে।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা মাওলানা ভাসানীকে বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি, বাংলাদেশের অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার্স মনে করি। বাংলাদেশের কোনো একজন জাতির পিতা নয়, বাংলাদেশে অনেকজন জাতির পিতা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম রয়েছেন মাওলানা ভাসানী।’
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা গতকাল এসেই মাওলানা ভাসানীর কবর জিয়ারত করেছি। মাওলানা ভাসানীর সেই দরবার হলে আমরা বসেছি কৃষকদের সাথে। আমরা বসেছি তাঁতি শিল্পীদের সাথে। টাঙ্গাইল কৃষক আন্দোলনের সূতিকাগার। টাঙ্গাইলের কৃষকরা সংগঠিত হতো, কিন্তু বাংলাদেশে এখন শক্তিশালী কৃষক সংগঠন নাই। কৃষকদের কথা বলার কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। কৃষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার পায় না।’
‘আমরা এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে কৃষকের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারব। কৃষকরা বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। আমরা বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ংপূর্ণতা অর্জন করতে চাই। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে শহীদ হয়েছে, সেই শহীদদের ধারণ করে আমরা নতুন বাংলাদেশ তৈরি করব। মাওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকদের অসামাপ্ত কাজ আমরা সম্পন্ন করব, এই শপথ আমরা নিচ্ছি’, যোগ করেন এনসিপির আহ্বায়ক।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দু জনগোষ্ঠীদের বাসভবনে, বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে। লুটপাট চালানো হয়ে আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। আমাদের নবীজিকে (সা.)-কে কেউ যদি কটূক্তি করে, আমাদের ধর্মকে কেউ যদি অবমাননা করে আমরা অবশ্যই তার বিচার চাই। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে আইনের আওতায়। আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। কিন্তু সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি কেউ সেই সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আনে, সেই ঘটনাকে আমরা কখনই মেনে নেবো না। আমাদের ধর্ম এটাকে পারমিট করে না। আমাদের ধর্মে বলা আছে—পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে দায়ী করা যাবে না। অন্য ধর্মের ওপর আঘাত করার শিক্ষা আমাদের নবীজি দেননি। আমাদের নবীজি অন্য ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা সবসময় নিশ্চিত করতেন। ফলে এই ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য ধর্মীয় নয়। তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক, তাদের উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক এবং তাদের উদ্দেশ্য লুটপাট করা। এই রাজনীতি শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ, সংখ্যালঘুদের জমি দখল ও বিচার না করার রাজনীতি। আমরা বলতে চাই, রংপুরে যারা ঘটাচ্ছে তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যিনি ধর্ম অবমাননা করেছেন তাকেও বিচার আওতায় আনতে হবে। আমরা ধর্মীয় সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে চাই। ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই।’