বাজেট : মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে৷ বাজেটে শতকরা পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সরকার নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন ও বেতার ভাষণের মাধ্যমে এই বাজেট উত্থাপন করেন৷ এটি বাংলাদেশের ৫৪তম বাজেট এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট৷
এবারের বাজেটের আকার আগের বছরের চেয়ে কিছুটা ছোট করে সাত লাখ ৮৯ হাজার হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা করা হয়েছে৷ বিদায়ী অর্থ বছরের (২০২৪-২৫) বাজেট ছিল সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার৷ এডিপির আকারও কমানো হয়েছে৷ আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা৷ বাজেট ঘাটতি দুই লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩.৬ শতাংশ৷ মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ নমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে৷
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, জুনের মধ্যেই মূল্যস্ফীতি আট শতাংশে নামবে৷ এডিপি দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এর মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা৷ সরকারি তহবিল থেকে রয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা৷ বাজেটে কর কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে৷ ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে৷ ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়েছে৷
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘‘প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে৷ তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে৷”
এবারের বাজেটকে তিনি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী উল্লেখ করে বলেন, ‘‘মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ-এই অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোনো রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত৷ এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে৷ পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যে সকল সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়েছে৷”
‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের আকাঙ্খার প্রতিফলন দেখছি না’
তবে অর্থনীতিবিদ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘আসলে বাজেটের যে পুরোনো কাঠামো তার মধ্যেই নতুন কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যে একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের আকাঙ্খা ছিল তার প্রতিফলন এই বাজেটে আমি দেখছি না৷”
অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘বাজেটে বৈষম্য দূর করা, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ নিয়ে কথা আছে৷ কিন্তু সেটা কীভাবে হবে তা আমি দেখতে পাচ্ছি না৷ ফলে এটা আগের মতোই একটি কথার বাজেটই থেকে যাবে বলে মনে হচ্ছে৷ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়িয়ে বৈষম্য দূরের পদক্ষেপ নেওয়া যেত এবারের বাজেটে৷”
ড. সেলিম রায়হান, ‘‘কৃষি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে৷ শিল্প ও বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ৷ তাহলে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে৷ আর মূল্যস্ফীতিইবা কীভাবে কমবে- বাজেটে তো তা বলা হয়নি৷ আর অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন ব্যয় কমানো বা কাটছাঁটের কথা আগে বলা হলেও সেটা কিন্তু সামান্যই করা হয়েছে৷ গরীব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সামাজিক খাতেও তেমন কোনো প্রতিফলন নেই৷”
এবারের বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও মূল্যস্ফীতি কমানো৷ রাজস্ব আদায় বাড়ানো৷ দারিদ্র দূরীকরণ এবং সামাজিক সুরক্ষাও বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে৷ বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে দেশে নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র হতে পারে৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল৷ পরের চার মাস অর্থাৎ এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে ছিল৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গড়ে ১০ শতাংশের বেশি ছিল৷ দীর্ঘসময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করায় সাধারণ মানুষ বা সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাপন আরো কঠিন হয়েছে৷
‘মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘‘এই বাজেটে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার কোনো পদক্ষেপ আমার চোখে পড়ছে না৷ সেটা বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রে৷ এখন বিনিয়োগ না বাড়লে তো উৎপাদন বাড়বে না৷ আবার কর্মসংস্থানও হবে না৷ এর সঙ্গে আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি৷ সব মিলিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তো বাড়বে না৷ সেটা না হলে তো অর্থনীতি যে আরো সচল করা প্রয়োজন তা হচ্ছে না৷”
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী আরও বলেন, ‘‘সরকার কর আদায় বাড়াতে চায়৷ ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে৷ আবার করপোরেট করও বাড়ানো হয়েছে৷ ভ্যাট বাড়ালে তো সাধারণ মানুষের ওপর এর চাপ পড়বে৷ নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে৷ তাহলে তো মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে৷”
পারভেজ বলেন, ‘‘শিল্প উৎপাদনের জন্য যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ তার উচ্চ মূল্য৷ আবার সেটা ঠিক মতো পাওয়া যায় না৷ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি নেই৷ ফলে ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ কোনো ক্ষেত্রেই ইতিবাচক কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ বাজেটেও তার কিছু দেখতে পাচ্ছি না৷”
প্রস্তাবিত বাজেটে বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ ৯৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ সুদ ব্যয় এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদ্যুৎ ও সার বাবদ ভর্তুকি দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা৷
এডিপিতে বরাদ্দের ৭০ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে পাঁচটি খাতে৷ এগুলো হলো পরিবহণ ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি; স্বাস্থ্য৷ পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে মোট ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে৷ এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা৷
তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষা খাতে৷ এ খাতে এডিপিতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা৷ গৃহায়ণ খাতে ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা; স্বাস্থ্যে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা; স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৬ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা; কৃষিতে ১০ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা; পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১০ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা; শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৫ হাজার ৩৮ কোটি টাকা; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ৩ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা৷
বাজেটের তিন প্রধান চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘‘দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ছে৷ বাজেটে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে তা বলা হচ্ছে না৷ ফলে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে যে ৬.৫ শতাংশ করা হবে তার তো কোনো বাস্তব পদক্ষেপ এই বাজেটে নেই৷”
‘‘আমি মনে করি এই সময়ে বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান এই তিনটি হলো এই বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ৷ এই তিনটির ওপর নির্ভর করছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা৷ কিন্তু বাজেট যেটা হয়েছে তা দিয়ে এই তিনটি চ্যালেঞ্জ সরকার মোকাবিলা করতে পারবে কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে,” বলেন তিনি৷
ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘‘সব মিলিয়ে অর্থনীতি একটি নিম্নস্তরের ভারসাম্যের ফাঁদের মধ্যে চলে যাচ্ছে৷ সেখান থেকে অর্থনীতিকে বের করে আনার কোনো উদ্যোগ আমি দেখছি না৷ এর জন্য অর্থ বরাদ্দ দরকার৷ কিন্তু তার চেয়ে বেশি দরকার নীতি সহায়তা৷”
মূল্যস্ফীতির চাপ আর অর্থনীতির বাস্তবতায় নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে৷ তবে কর বাবদ আয় বাড়াতে কর ধাপ সাতটি থেকে কমিয়ে ছয়টি করার কথা বলা হয়েছে৷ তাতে করযোগ্য হলেই আগের চেয়ে বেশি হারে কর দিতে হবে৷ সার্বিকভাবে অধিকাংশ করদাতার ওপর করের চাপ বাড়বে৷
বাজেটে সাধারণভাবে করমুক্ত আয়ের সীমা গতবারের তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷
বাজেটে অনেক পণ্যের ওপর নতুন করে কর বসানো হয়েছে৷ আবার কিছু পণ্যে কর রেয়াত দেওয়া হয়েছে৷ ফলে অনেক পণ্যের দাম বাড়বে৷
‘মানুষের ওপর নতুন করে করের বোঝা চাপবে’
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘কাঠামোগত কোনো ধরনের পরিবর্তন না করে এনবিআরকে কর বেশি আদায়ের টার্গেট দেওয়া হয়েছে৷ ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে৷ তাতে তো সাধারণ মানুষের ওপর নতুন করে করের বোঝা চাপবে৷ এখানে করের নেট বাড়ানো, কর আদায়ে দক্ষতা বাড়ানো, কর প্রশাসনে দুর্নীতি দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল- তা তো হয়নি৷ আমার মনে হয় না এনবিআর পাঁচ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করতে পারবে৷”
‘‘সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা দিচ্ছে৷ কিন্তু কর্মসংস্থান ও মানুষের আয় না বাড়লে সরকারি কর্মচারীদের ওই টাকা বাজারে ঢুকে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে৷ আসলে আইএমএফের পরামর্শে সামান্য কাটছাঁট করে একটা বাজেট করা হয়েছে,” বলেন তিনি৷