দেশে তিনজনে একজন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত

দেশে প্রায় চার কোটি ৫০ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুষ্টিবিদ-বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কম খাই হাঁটি বেশি, ফ্যাটি লিভার দূরে রাখি’ শীর্ষক জনসচেতনতামূলক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুষ্টিবিদ-বিজ্ঞানীরা পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, প্রতি তিনজনে একজনের ফ্যাটি লিভার রয়েছে। অথচ প্রায় ক্ষেত্রে শুধু খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস ও জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন এবং ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ও ন্যাশ প্রতিরোধ করা যায়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুষ্টিবিদ-বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেন, ফ্যাটি লিভার বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের কারণ হিসেবে ভাইরাসকে অতিক্রম করে ইদানীং ফ্যাটি লিভার প্রাধান্য বিস্তার করছে।
তাঁরা আরও জানান, সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার বিশেষত ভাত বেশি গ্রহণ করছে এবং সেই তুলনায় শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটা-চলা কম করছে, তাদের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওর সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। বাইরের খাবার গ্রহণ, দিনে পাঁচ ঘণ্টার উপরে যাদের বসে থাকতে হয় এবং একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম কম তাদের এ ঝুঁকি সবচাইতে বেশি।
আলোচকরা খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী খাদ্য তৈরি করতে বাধ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
লিভার রোগজনিত মৃত্যু বিশ্বব্যাপী মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে পরিগণিত। লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লিভারে চর্বি জমাজনিত প্রদাহ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস। অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়ার কারণে যকৃতে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয় তাকেই স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস বলা হয়। ফ্যাটি লিভারের বিপজ্জনক পরিণতি হচ্ছে ন্যাশ। নির্ণয়হীন ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ফ্যাটি লিভার বিপজ্জনকভাবে ন্যাশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করা ছাড়াও যকৃতে চর্বি জমার আরও বেশ কিছু খারাপ দিক রয়েছে। এই রোগটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শরীরে ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব আশংকাজনক হারে বাড়ছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক (ডা.) এ এস এম মতিউর রহমান (অব.) বলেন, ফ্যাটি লিভারকে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মাল্টি সেক্টরকে যুক্ত করে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এই রোগ প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ করে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যেমন কাজ করতে হবে একই সঙ্গে কমিউনিটিকেও যুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিতে হবে। ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে শৈশব থেকেই সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো শাহিনুল আলম বলেন, ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধই প্রধান চিকিৎসা। মাত্র একটি পরীক্ষা করেই এই রোগ চিহ্নিত করা সম্ভব। ফ্যাটি লিভারের ধরন অনুযায়ী রোগীদের স্বার্থে বিজ্ঞান সম্মতভাবে চিকিৎসা দিতে হবে। রোগটি প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এলজিইডিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।
ফ্যাটিলিভার প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ :
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে ফ্যাটিলিভার রোগ প্রতিরোধে কর্মপন্থা নির্ধারণে যে সুপারিশ তুলে ধরেন সেগুলো হলো প্রত্যেক ব্যক্তির সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন এবং প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করে হাঁটতে হবে। দড়ি লাফ এবং সাইকেল চালানো শরীরচর্চার জন্য ভালো। দুধ, ফল, শাক-সবজি খাওয়া বাড়ানো এবং চিনিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, চকলেট, আইসক্রিম, ফাস্ট ফুড এবং (ভাজা খাবার) ট্রান্স-ফ্যাটের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ক্যালরি গ্রহণ কমাতে হবে। শরীরচর্চা বাড়ানো যায় এ রকম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের প্রতিটি স্কুল এবং প্রশাসনিক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং প্রতিটি শিশুকে খেলতে এবং অন্যান্য শারীরিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। মেইন রোডের পাশে বাইসাইকেল চালানো এবং হাঁটার জন্য আলাদা লেন তৈরি করা, যা স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্য উপকারী হবে। গণ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অধিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণযুক্ত জাংকফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের পুষ্টিমান সঠিক রাখার জন্য (উদাহরণ স্বরূপ, ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণ পরিহার) খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের অধীনে আনতে হবে। সফট ড্রিংক্সের পরিবর্তে ফ্রেস ফলের জুস এবং পানি পানকে উৎসাহিত করতে হবে। ছোট-বড় সবার জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, স্কুল এবং কর্মস্থলে পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে পুষ্টিমান এবং শক্তিমান (ক্যালরি) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সব চিকিৎসককে ফ্যাটি লিভার সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর দিকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা ন্যাশের ঝুঁকিতে না পড়ে। ব্যবহার ও প্রয়োগ কমানোর জন্য ‘চর্বি বা চিনি কর’ (FAT Tax) ধার্য করার চিন্তা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স মেজর জেনারেল অধ্যাপক (ডা.) এ এস এম মতিউর রহমান (অব.) এবং প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বারডেম হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. গোলাম আযম।
আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ও হেপাটোলজি সোসাইটির বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ডা. মো. সাইফুল ইসলাম এলিন।
আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, বাংলাদেশ গ্যাস্টোএন্টারোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেওয়ান সাইফুদ্দিন আহমেদ, হেপাটোলজি সোসাইটির প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক ট্রান্সপ্লান্ট হেপাটোলজিস্ট ডা. তানভির আহমাদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা আবিদ জাফর, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের সিনিয়র কনসালটেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. এস কে বাহার হোসেন, অ্যাসোসিয়েশন ফর দি স্টাডি অব লিভার ডিজিজেস বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. ফিরোজ আমিন, জাইকার সিনিয়র ফুড সেফটি কনসালটেন্ট মো. মাসুদ আলম, স্পাইস টেলিভিশন লিমিটেডের সম্পাদকীয় প্রধান তুষার আবদুল্লাহ, সংগীত শিল্পী খান আসিফুর রহমান (আগুন) প্রমুখ।

ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ন্যাশনাল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. কামরুল আনাম।