ক্যাথরিন মাসুদকে জেরার সময় যা হলো

চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরের মৃত্যুর ঘটনায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলার বাদিকে জেরা শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার প্রথমদিন এক ঘণ্টার জেরা শেষে আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ মামলার শুনানি চলছে।
জেরার শুরুতে বাস ড্রাইভারের পক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার ক্যাথরিন মাসুদকে জিজ্ঞাসা করেন, দুর্ঘটনার একই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে আপনি জানেন কি?
ক্যাথরিন মাসুদ : হ্যাঁ জানি।
আইনজীবী : মনিকগঞ্জ জজ আদালতে যখন মামলা হয় তখন আপনি কি ওখানে সাক্ষী দিয়েছেন?
ক্যাথরিন : হ্যাঁ, আমি সাক্ষ্য দিয়েছি।
আইনজীবী : আপনি মানিকগঞ্জের কমপ্লেইন ট্রাইব্যুনালে যে মামলা করেছিলেন সেদিন কি আপনাকে (আপনার অভিযোগ) কোর্ট কোনো পরীক্ষা করেছিলেন?
ক্যাথরিন মাসুদ : না আমাকে অভিযোগের বিষয়ে পরীক্ষা করেননি।
আইনজীবী : মানিকগঞ্জের ট্রাইব্যুনালে আসামি বাস ড্রাইভার যে জবাব দিয়েছেল তা আপনি জানেন?
ক্যাথরিন : সম্ভবত লিখিত একটি বক্তব্য দিয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি স্মরণ করতে পারছি না।
আইনজীবী : আপনি মামলার আরজিতে যেভাবে অভিযোগ উল্লেখ করেছেন সেভাবে তো মামলা চলে না। সেটা কি জানেন?
ক্যাথরিন : বিষয়টি আমার স্মরণ নেই।
আইনজীবী : মোটরযানের অর্ডিনেন্স অনুযায়ী আপনার মামলাটি সঠিক হয়নি সেটি আপনি জানেন?
ক্যাথরিন : এ বিষয়ে আমার জানা নেই।
আইনজীবী : মানিকগঞ্জ আদালতে কত তারিখে সাক্ষী দিয়েছেন মনে আছে?
ক্যাথরিন : সেশন কোর্টে কত তারিখে দিয়েছি সঠিক তারিখ মনে নেই।
আইনজীবী : ঘটনার দিন বাসা থেকে আপনারা কয়টা বের হয়েছেন?
ক্যাথরিন : ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সকাল ৬টায় বের হয়েছি।
আইনজীবী : আপনাদের ড্রাইভার কে ছিল?
ক্যাথরিন : মোস্তাফিজুর রহমান।
আইনজীবী : আপনারা গাড়িতে ওঠার পর একাধিকবার ড্রাইভারকে দেখে শুনে চালাতে বলেছেন, এটা কি ঠিক?
ক্যাথরিন : আমি ড্রাইভারকে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে বলেছি। সে তাই করেছিল। সে আমার কথার সম্মান দেখিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়েছিল।
আইনজীবী : আপনি সাবধানে গাড়ি চালাতে বলেছেন এটা ঠিক?
ক্যাথরিন : বাংলাদেশের রাস্তা খুবই বিপজ্জনক। তাই যখন গাড়িতে উঠতাম, তখন সতর্ক থাকতাম। আমরা নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই যত্নবান ছিলাম।
আইনজীবী : মানিকগঞ্জে থেকে ঢাকা ফেরার পথে ড্রাইভারকে সতর্ক করেছিলেন?
ক্যাথরিন : ২০১১ সালে ১৩ ঢাকা ফেরার পথে বৃষ্টির কারণে সতর্কতার সাথে চালাতে বলেছি।
আইনজীবী : গাড়ি চলন্ত অবস্থায় খাওয়ার হোটেল খুঁজে বের করতে বলেছিলেন?
ক্যাথরিন : যখন মানিকগঞ্জের যাচ্ছি তখন গাড়ি ধীরে ধীরে চলছিল। আমরা নিজেরা বাহিরে তাকিয়ে হোটেল আছে কি না তা দেখছিলাম।
আইনজীবী : আপনাদের ড্রাইভারও গাড়ি চালাচ্ছিল আর হোটেল খুঁজছিল এটা কি ঠিক?
ক্যাথরিন : এটি সঠিক নয়। আমরা নিজেরা বাহিরের দিকে তাকিয়ে হোটেল খোঁজার চেষ্টা করছিলাম।
আইনজীবী : আপনি মাইক্রোবাসে উল্টো হয়ে বসেছিলেন, ঠিক?
ক্যাথরিন : আমি মাইক্রোবাসের পিছনে বসে ছিলাম।
আইনজীবী : আপনার ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল কি না জানতেন?
ক্যাথরিন : আমার জানামতে ড্রাইভারের লাইসেন্স ছিল। দুর্ঘটনার সময় লাইসেন্স ছিল।
আইনজীবী : ওই সময় ড্রাইভারের লাইসেন্সর মেয়াদ ছিল কি না জানতেন?
ক্যাথরিন : হ্যাঁ, ড্রাইভারের লাইসেন্সের মেয়াদ তখনো শেষ হয়নি।
আইনজীবী : মানিকগঞ্জের তদন্ত কর্মকর্তাদের কি লাইসেন্স দিয়েছিলেন?
ক্যাথরিন : দিতে পারিনি, কারণ তখন ওটি আমার সঙ্গে ছিল না।
আইনজীবী : আপনি কি নিজের টেস্টিমোনিয়াম সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন?
ক্যাথরিন : হ্যাঁ, ২০১২ সালে মামলা দায়ের করার সময় দিয়েছিলাম।
আইনজীবী : এই মামলায় আর কারা সাক্ষী দেবেন জানেন?
ক্যাথরিন : জানি, আমি ছাড়া ঢালি আল মাহমুদ, বেগম দিলারা, সাইফুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, লুৎফুর রহমান, ড. নিয়াজ রহমান সাক্ষ্য দেবেন।
আইনজীবী : উচুঁ মানের ব্যক্তিদের ড্রাইভাররা গাড়ি চালানোর সময় একটু বেপরোয়া গাড়ি চালায়। আর ওনারা যে মাপের ব্যক্তি ওনাদের ড্রাইভারও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়েছে।
ক্যাথরিন : এটি সঠিক নয়।
এ পর্যায়ে আদালত মামলার জেরা আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন। আগামীকাল বুধবারও ক্যাথরিন মাসুদকে জেরা করবেন বাস ড্রাইভারের আইনজীবী আবদুস সোবহান তরফদার।
২০১১ সালের ১৩ অগাস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীর। তারেক ও মিশুককে বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে চুয়াডাঙ্গাগামী একটি বাসের সংঘর্ষ ঘটে। তাতে তারেক-মিশুকসহ মাইক্রোবাসের পাঁচ আরোহী নিহত হন।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। ঘটনার দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অর্ডিন্যান্সে ১২৮ ধারায় বাসমালিক, চালক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মোকদ্দমা করেন। মামলায় ড্রাইভার জমির হোসেন, বাস মালিক কাসেদ মিয়া, মুজিবুল হক, মো. তুহিন, রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে বিবাদী করা হয়েছে। এদের সবাই জামিনে রয়েছেন।
মামলায় তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ সাত কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৫২ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
এরপর সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে মোকদ্দমা দুটি জনস্বার্থে হাইকোর্টে বদলির নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন বাদীরা।
ক্যাথরিনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন। অ্যাডভোকেট রমজান আলী শিকদার, ব্যারিস্টার বিলকিস আক্তার মিলি। অপরদিকে বাস ড্রাইভারের পক্ষে আজ জেরা করেন অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান তরফদার।
সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা কোনো মোকদ্দমা প্রথমবারের মতো উচ্চ আদালতে শুনানি হচ্ছে। সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদের আলোকে হাইকোর্টে বদলির জন্য বাদীদের করা আবেদন মঞ্জুর করে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন।
বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ে মোকদ্দমা দুটি এই বিভাগের (হাইকোর্ট) উপযুক্ত বেঞ্চে পাঠানোর পক্ষে মত দেন। এজন্য উপযুক্ত বেঞ্চ গঠন বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রধান বিচারপতির কাছে দুই মোকদ্দমার নথি ও আদালত বদলির আবেদনের নথি পাঠানো হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি জিনাত আরা নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে পাঠান। এর ধারাবাহিকতায় দুটি মামলা বেঞ্চের তালিকায় শুনানির জন্য আসে। মামলায় পাঁচজনকে বিবাদী করা হয়।