সেতু নির্মাণে জটিলতায় দুর্ভোগে গোপালগঞ্জ পৌরসভার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ

৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৪০ মিটার প্রস্থের পাঁচুড়িয়া খাল। খালটি গোপালগঞ্জ শহরের প্রাণ। এ খালের দুপাড় জুড়ে অন্তত ১৬ হাজার পরিবারের বসবাস। রাস্তা কেটে শহর মধুমতি নদীর সাথে এ খালের সংযোগ স্থাপন করা হয় ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর। তখন সড়কে দেওয়া হয় বেইলি সেতু। তারপর গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট-ঘোনাপাড়া সড়ক প্রকল্পের আওতায় পাঁচুড়িয়া খাল ও মধুমতি নদীর সংযোগ স্থলের বেইলি সেতুর জায়গায় একটি সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। বিআইডব্লিউটিএ ৫.০ মিটার ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স হিসাব করে সেতুর ডিজাইন করে৷ ২০২৩ সালের মে মাসে খাল ও নদীর সংযোগস্থলে বাঁধ দেওয়া হয়। তারপর সিসি ব্লক দিয়ে পাড় বাঁধানো সহ সৌন্দয্য বর্ধনের কাজ করা হয়। এখন বেইলি সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ভারী যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এরমধ্যে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজও প্রায় শেষের পথে। কিন্তু ওই স্থানে সেতু নির্মাণে দেখা দিয়েছে জটিলতা। অপরদিকে খাল ও নদীর মধ্যে ২ বছর ধরে পানিপ্রবাহ বন্ধ রয়েছে। এতে খালের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মারাত্মক দূষণে খালপাড়ে বসবাসকারী অন্তত ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। স্থানীয়রা দ্রুত সেতু নির্মাণ করে পানি প্রবাহ সচল করার দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বিআইডব্লিউটিএ, জেলা প্রশাসন, সড়ক বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও গোপালগঞ্জ পৌরসভার একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ আগামী ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করে দ্রুত সেতু নির্মাণের জটিলতা অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী এএফএম রিফাত জামিল জানান, পাঁচুড়িয়া খালপাড়ে পাকিস্তান সরকার খাদ্য গুদাম নির্মাণ করে। তখন শহর মধুমতি নদী ও পাঁচুড়িয়া খালের সংযোগস্থলে প্রচণ্ড স্রোত ছিল। স্রোতের কারণে খাদ্যগুদাম ভাঙনের কবলে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা দেখা দেয়। পরে ১৯৫৯ সালে সরকার খালটির মুখে বাঁধ দেয়। ফলে শহর মধুমতি নদীর সাথে পাঁচুড়িয়া খালের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে ওই বাঁধ ঘেঁষে মার্কেট ও সড়ক নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে পানিপ্রবাহ বন্ধ থাকায় দূষণ আর দখলে পাঁচুড়িয়া খালটি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। স্থানীয়রা এ খালটি রক্ষার দাবি জানান। তাদের দাবির মুখে ২০২২ সালের নভেম্বরে বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ এবং সড়ক কেটে পাঁচুড়িয়া খাল থেকে শহর মধুমতি নদীর সংযোগ স্থাপন করে দেওয়া হয়। প্রাণ ফেরে পাঁচুড়িয়া খালের। পরে সংযোগস্থলে বাঁধ দেওয়া হয়। সেখানে সিসি ব্লক স্থাপন, পাড় বাঁধানোসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন সড়কের ওপর সেতু নির্মাণের জটিলতা দেখা দিয়েছে। বাঁধ খুলে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই খালের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে খালপাড়ের মানুষের।
গোপালগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট-ঘোনাপাড়া সড়ক প্রকল্পের ৪৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৪৩.৩ কিলোমিটার সড়কের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে মাত্র ৭০০ মিটারের কাজ। কিন্তু প্রকল্পে শহর মধুমতি নদী ও পাঁচুড়িয়া খালের সংযোগস্থলে একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাবনা রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ ৫.০ মিটার ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স হিসাব করে সেতুটির ডিজাইন করে৷ সেতুর অস্বাভাবিক উচ্চতার কারণে অ্যাপ্রোচ সড়কের সামঞ্জস্যতা ঠিক রাখতে আশপাশের জমি অধিগ্রহণ ও একটি আন্ডারপাস নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে অবস্থার প্রেক্ষিতে বিআইডব্লিউটিএকে ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ১.৫ মিটার প্রদান করার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বিধিমালা অনুযায়ী তারা ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ৩.৫ মিটার নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এতেও সেতুর উচ্চতা অস্বাভাবিক রয়ে যায়। ফলে বাস্তবায়নে দেখা দেয় জটিলতা। তাই ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স ১.৫ মিটার নির্ধারণ করা হলে স্বাভাবিক উচ্চতায় সেতুটি নির্মাণ করা সম্ভব।
দ্রুত সেতু নির্মাণে জটিলতা অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ (মেরিন) বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আব্দুর রহিম বলেন, নদী, খাল, বিল সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। তাই পাঁচুড়িয়া খাল ও শহর মধুমতি নদী যাতে নিরাপদ থাকে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমরা ১৭ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বাস্তবতার নিরিখে আমরা আগামী ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেব।
গোপালগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক বিশ্বজিৎ কুমার পাল বলেন, পাঁচুড়িয়া সেতু নির্মাণের জটিলতা নিরসনে বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জমানের মধ্যে ১৭ এপ্রিল ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
পাঁচুড়িয়া খালপাড়ের বাসিন্দা সমর বাইন বলেন, খালের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মারাত্মক দূষণের কারণে খালের পানি কোন কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এটি মশা, মাছির জন্ম দিচ্ছে। মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। তাই দ্রুত খালের পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
পাঁচুড়িয়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান মানিক বলেন, পাঁচুড়িয়া বেইলি সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ভারী যানবাহন চলাচল করতে পারে না। যে কোনো সময় সেতুটি ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটতে পরে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে যানবাহন চলাচল। তাই পাঁচুড়িয়া সেতুর কাজ দ্রুত শুরু করার দাবি জানাচ্ছি।
খালপাড়ের বাসিন্দা ও পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর হাজী মো. হুমায়ুন কবির শিকদার জানান, আমরা সেতুটি নির্মাণের জটিলতা নিরসনে এর দ্রুত সমাধান চাই। সেতুর উচ্চতা বেশি হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি স্থাপনা ভেঙে ফেলতে হবে। ফলে অর্থনীতির ক্ষতি হবে। তাছাড়া খালটি ছোট, তাই এখানে বড় ধরনের কোনো সেতু না করলেই চলে।