স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল, হঠাৎ কেঁপে উঠল বাংলাদেশ

একটু একটু করে দানা বাঁধছিল ক্ষোভ। অল্প কয়েকদিনেই সেই ক্ষোভ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে সকল তরুণের মনে। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই তরুণ মনের সেই স্ফুলিঙ্গের ছোয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, মারধর ও গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস, রক্তাক্ত হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সারা দেশ। নিন্দা জানান দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। নিন্দার ঝড় ওঠে সারা বিশ্বে।
এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে পরদিন ১৬ জুলাইও। সকাল থেকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সশস্ত্র হামলা চালায়। আন্দোলনটা তখন আর কেবল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল না, ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, রংপুর ও রাজশাহীতেও তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে।
রাজধানীর সায়েন্সল্যাবে আওয়ামী সমর্থকরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। পুরো সংঘর্ষের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। ফলে এক পক্ষ আরেক পক্ষের দিকে ইটপাটকেল ছুড়ছিল নির্বিঘ্নে। লাঠি দিয়েও পেটানো হচ্ছিল। সাইন্সল্যাব মোড়ের দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ জনতা অবস্থান নেয়। অপরদিকে ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেটের দিকে অবস্থান নেয় আওয়ামী সমর্থকরা। দফায় দফায় সংঘর্ষে এ দিন সাইন্সল্যাবে দুজন প্রাণ হারান।
এ পুরো সময়ে সেখানে আমার সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী চিত্রসাংবাদিক ইব্রাহিম হোসেন। আমরা পুরো সংঘর্ষের মধ্যেই ছিলাম। আমি ইটের আঘাতে আহত হই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে আমাদের সঙ্গে থাকা এনটিভির গাড়িকেও ধাওয়া দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে আমাদের চালক আর সাইন্সল্যাব এলাকায় থাকতে পারেননি।
সায়েন্স ল্যাবে সংঘর্ষের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মোড়ে মোড়ে কোটা সংস্কারের পক্ষের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। অপরদিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী সমর্থকরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। দুপক্ষের এ মুখোমুখি অবস্থান দফায় দফায় সংঘর্ষে গড়ায়। কখনও ছাত্রলীগকে ধাওয়া, কখনওবা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেওয়া হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের লোহা রড ও লাঠিসোঁটা দিয়ে মারধর করা হয়। ক্যাম্পাসের নারী-পুরুষ সব শিক্ষার্থীরা এদিন সক্রিয়ভায়ে অংশ নেয় আন্দোলনে।
ঢাকার বাইরে রংপুর ও চট্টগ্রামে আন্দোলন বেগবান হয়। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম নিহতের ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ। তাকে যখন দফায় দফায় গুলি করা হয়, তিনি দুহাত প্রসারিত করে গুলি ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এক সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সে সময় এনটিভি ঘটনাটি লাইভ সম্প্রচার করে। মুহূর্তেই ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। ঘৃণায় আর ক্ষোভে ফেটে পড়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। স্ফুলিঙ্গ পরিণত হলো দাবানলে, কেঁপে উঠল পুরো বাংলাদেশ।
এদিন তীব্র আন্দোলন হয় চট্টগ্রামেও। এখানে আন্দোলনের দ্বিতীয় শহীদ ওয়াসিম আকরাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে ওয়াসিম ফেসবুকে লেখন, ‘চলে আসুন ষোলশহর’। ষোলশহর ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে এদিন তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন। এ ঘটনার পর সারা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরাসহ সারা বিশ্ব থেকে নিন্দার ঝড় ওঠে।
গত বছরের এই দিনে (১৬ জুলাই) আন্দোলন তীব্র হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়।
এ ঘটনাটি শুধু রাবির শিক্ষার্থীদের কাছেই নয়, সমগ্র জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত। এরপর থেকে একে একে সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। যা আন্দোলনে অন্যরকম গতি আনে। সর্বশেষ ১৭ জুলাই দুপুরে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ হারায় ঢাবির সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে। পরে সব হলের ছাত্রলীগের নেতাদের রুম ভাঙচুর করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনের তীব্রতা এত বেড়ে যায় যে সড়কে স্রোতের মতো নেমে আসে জনতা। নেমে আসেন মা-বোনেরা। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পেটুয়া বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গুলির মুখে দ্বিধাহীনভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন তারা। ফলশ্রুতিতে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পালাতে বাধ্য হন।
জুলাই-আগস্টের এ আন্দোলনে সহস্রাধিক শহীদ হন। কয়েক হাজার আন্দোলনকারী আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করে। ‘জন্মভূমি অথবা মৃত্যু’— এ স্লোগানে তরুণ সমাজ শপথ নেয়— শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায় তার জন্য অতন্ত্র প্রহরী হয়ে কাজ করবেন তারা।
লেখক : সাংবাদিক