শরণার্থী শিবির থেকে মাদ্রিদের ইতিহাসে মদ্রিচের যাত্রা

শিশুকাল কেটেছে ভয়াবহতায়। দেখেছেন শান্তির নামে যুদ্ধ নামক অশান্তি। আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে যেতে ছিল মানা। যদি প্রাণে না বাঁচে। অনিশ্চিত এক জীবন ছিল যার, তার জীবনে এসেছে বসন্ত। লুকা মদ্রিচ অনেকটা ওয়াইনের মতো। বয়স যত বাড়ছে, সময় যত গড়াচ্ছে, তার ঝাঁঝ তত বাড়ছে! বছরের সব থেকে জঘন্যতম সাইনিং থেকে হয়েছেন বিশ্বসেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের প্রাণভোমরা।
সময়টা ২০১২। ইংলিশ ক্লাব টটেনহাম থেকে রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখান এক তরুণ মিডফিল্ডার। স্প্যানিশ ক্লাবটি যখন ঘোষণা দেয় তাকে দলে ভেড়ানোর, চারিদিকে রীতিমতো হায় হায় রব ওঠে। এ কাকে নিল মাদ্রিদ? অবাক বিস্ময়ে মাদ্রিদের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সাইনিং হিসেবে তাকে আখ্যা দিয়ে বসে সমর্থক থেকে শুরু করে অনেক বিশ্লেষকও। মদ্রিচ নিরবে সয়ে গেছেন। এরপর কেটেছে ১৩ বছর। সাদামাটা এক সাইনিং থেকে লস ব্লাংকোদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছেন এই ক্রোয়েশিয়ান তারকা। নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তিদের কাতারে।
যার আগমনে উঠেছিল হাসি-ঠাট্টার রব, তার বিদায়ে অশ্রু ঝরেছে প্রতিটি ভক্তের চোখের কোণ বেয়ে। নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারকে বিদায় বলা কি এতই সহজ? তবু, বলতে হয়। কালের নিয়ম মানতে হয়। ৩৯ বছরের জীবনের এক তৃতীয়াংশ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে কাটিয়ে মদ্রিচও তাই চলে গেলেন নতুন ঠিকানায়। রেখে গেলেন তার লিগ্যাসি। মাঝমাঠে অনেক মহাতারকা এলেও, মদ্রিচরা আসেন খুব কম।
মদ্রিচকে অনায়াসে সর্বজয়ী বলা যায়। সাদা জার্সিতে ফর্মহীনতায় মাঠের বাইরে কবে ছিলেন, তা জানতে মোটামুটি গবেষণা করতে হবে। একজন মদ্রিচকে বসিয়ে রাখার দুঃসাহস দেখাননি কোনো কোচ। তারার হাটে আলাদা দ্যুতি যিনি ছড়ান, যাকে ছাড়া পরিকল্পনা সাজানো যায় না, তাকে বসিয়ে রাখার যুক্তি নেই। মদ্রিচ যেন পাশের বাসার সেই ছেলেটা, বিকেল হলে যার একটাই ধ্যানজ্ঞান থাকে। ফুটবল নিয়ে বসে পড়ো। দুনিয়ায় অন্য কিছু নেই। মাঠের এক কোণে একটা ফুটবলকে সঙ্গী করে একমনে ধ্যান করে যেতে যার কোনো ক্লান্তি আসে না।
গত ১৩ বছরে মদ্রিচকে ছাড়া কল্পনা করা যায়নি মাদ্রিদের মাঝমাঠ। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মাদ্রিদে সম্ভাব্য সবকিছু জিতেছেন মদ্রিচ। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ৫৯৭টি ম্যাচে ৪৩ গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছেন ৯৫টি। ফুটবল ইতিহাসের সফলতম এই ক্লাবটির জার্সিতে ২৮টি শিরোপা জিতেছেন তিনি, যার মধ্যে ৬টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ৪টি লা লিগা, ২টি কোপা দেল রে এবং ৫টি স্প্যানিশ সুপার কাপ শিরোপা রয়েছে। ২০১৮ সালে ক্যারিয়ারের একমাত্র ব্যালন ডি’অর পেয়েছেন সাদা জার্সি গায়ে চাপিয়েই।

ঘরের ছেলে হয়ে মদ্রিচ নিয়ন্ত্রণ করেছেন মাঠের মধ্যভাগ। এত সুনিপুণ দক্ষতায় সবকিছু নিজের মতো করে সাজাতেন, মনে হতো বল যেন একান্ত বাধ্যগত। মদ্রিচও ভীষণ মায়ায় জড়িয়ে নেন বলকে। যতক্ষণ মাঠে থাকেন, মুগ্ধ হয় সবাই। একজন মদ্রিচকে কখনোই ছকে বাঁধা যায়নি। তিনি এগিয়েছেন নিজের মতো করে, ভালোসেছেন খেলাটিকে। আপন করে নিয়েছেন সাদা রক্তের ভক্তদের। সাক্ষী হয়েছেন উত্থান-পতনের। ক্লাবের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বিদায়ের আগে বিষাদ ছুঁয়েছে তাকেও।
মাদ্রিদ ছেড়ে আরেক বিখ্যাত ক্লাবে পাড়ি জমিয়েছেন মদ্রিচ। ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান তাকে এক বছরের চুক্তিতে দলে নিয়েছে। সুযোগ আছে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৭ পর্যন্ত করার। কেউ কেউ তো মজার ছলে বলছেন, মদ্রিচকে নিয়ে মিলান কেবল একজন ফুটবলার কেনেনি। কিনেছে গোটা একটা প্রতিষ্ঠান।

সময় নামক নদীর কিনারা ঘেঁষে মদ্রিচ হেঁটেছেন নিজের মতো করে। কাউকে খুশি করতে নয়, প্রমাণ করতে নয়। তিনি ধীর লয়ে চলেছেন নিজেকে রাঙাতে। আর যে নিজেকে রাঙাতে পারে, তার আভায় অন্যরা আলোকিত হয়। মাদ্রিদের মদ্রিচ এমনই এক রঙিন আভা, যা দ্যুতি ছড়াবে চিরকাল। কিংবদন্তিরা কেবল জায়গা পরিবর্তন করেন, তাদের লিগ্যাসির নড়চড় খুব একটা হয় না।