‘চতুর্দশ লিও’ নাম নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পোপ

যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট ফ্রান্সিস প্রেভোস্ট বৃহস্পতিবার (৮ মে) ইতিহাস গড়ে দেশটির প্রথম পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কার্ডিনালদের গোপন কনক্লেভের ভোটাভুটিতে তিনি ১৪০ কোটি ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক নেতা নির্বাচিত হন। পোপ নির্বাচিত হবার পর নিজের জন্য ‘চতুর্দশ লিও’ নামটি গ্রহণ করেন। খবর এএফপির।
সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার ভক্তের উল্লাসের মধ্যে সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার বারান্দায় আবির্ভূত হন নতুন পোপ। হাসিমুখে দু’হাত নেড়ে এবং মস্তক অবনত করে তিনি বিশ্ববাসীকে শান্তির বার্তা দেন, বলেন, ‘শান্তি আপনাদের সঙ্গী হোক।’
এর আগে সিক্সটিন চ্যাপেলের চিমনি থেকে সাদা ধোঁয়া বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন পোপ নির্বাচনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি ছিল কার্ডিনালদের ভোটিংয়ের দ্বিতীয় দিন। সাদা ধোঁয়া দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রোমের গির্জাগুলোতে আনন্দের ঘণ্টা বাজতে শুরু করে এবং হাজারো মানুষ বাসিলিকার সামনে ভিড় করে, যেখানে নতুন পোপের প্রথম ভাষণের জন্য লাল গালিচা বিছানো হয়েছিল।
আর্জেন্টিনার সংস্কারপন্থি পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি হিসেবে কার্ডিনাল রবার্ট ফ্রান্সিস প্রেভোস্টের নাম লাতিন ভাষায় ঘোষণা করা হয়।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট থেকে আগত ৩৯ বছর বয়সী শেফ জোসেফ ব্রায়ান এই মুহূর্তটিকে ‘এক অসাধারণ অনুভূতি’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি খুব একটা ধর্মভীরু মানুষ নই, কিন্তু এখানে এত মানুষের সমাগম আমাকে সত্যিই বিস্মিত করেছে।’
ব্রাজিলের পতাকা হাতে এক উচ্ছ্বসিত যাজককে অন্যের কাঁধে উঠে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা যায়, আবার অন্য একজন আকাশের দিকে একটি বিশাল ক্রুশ উঁচিয়ে ধরে বিজয়ের উল্লাস করেন।
‘হাবেমুস পাপাম’—আমাদের পোপ এসেছেন
‘হাবেমুস পাপাম, উউউউ!’—উল্লাসে চিৎকার করেন ৪১ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান নারী ব্রুনা হোদারা। তিনি তার নিজের ফোনে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধারণ করছিলেন, যখন চারপাশে সমবেত জনতা ‘ভিভা ইল পাপা!’—‘পোপ দীর্ঘজীবী হোন!’ বলে চিৎকার করতে থাকে।
জার্মানির মিউনিখ থেকে আসা ১৫ বছর বয়সী ফ্লোরিয়ান ফ্রিড এই অভিজ্ঞতাকে ‘এক জীবনে একবারই দেখার মতো’ বলে উল্লেখ করে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, পোপ ফ্রান্সিস গত মাসে ৮৮ বছর বয়সে মারা যান। বারো বছরব্যাপী তিনি করুণা ও সংস্কারের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন, যদিও তার উদার নীতি অনেক রক্ষণশীলদের অসন্তুষ্টির কারণও হয়েছিল।
নতুন পোপের কাঁধে এখন এক বিশাল দায়িত্ব—বিশ্বের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে নৈতিক নেতৃত্ব প্রদান, বিভক্ত ক্যাথলিক চার্চকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং বহু বছর ধরে চলে আসা যৌন নিপীড়ন কেলেঙ্কারির মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর মোকাবিলা করা।
রোমান সুরক্ষা ও ঐতিহ্য
পাঁচটি মহাদেশের ১৩৩ জন কার্ডিনাল পোপ নির্বাচনের জন্য ভ্যাটিকানের সিক্সটিন চ্যাপেলে নির্জনে গোপন কনক্লেভে অংশ নেন। বুধবার (৭ মে) দুপুরে তারা ভোটদান প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই নির্বাচন ছিল ক্যাথলিক ইতিহাসের সবচেয়ে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনগুলোর মধ্যে অন্যতম। নির্বাচনের অগ্রগতি জানানোর একমাত্র উপায় ছিল সিক্সটিন চ্যাপেলের চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া—কালো ধোঁয়া মানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, আর সাদা ধোঁয়া মানে নতুন পোপ নির্বাচিত।
বুধবার সন্ধ্যা ও বৃহস্পতিবার দুপুরে কালো ধোঁয়া বের হলে ভক্তদের মধ্যে সাময়িক হতাশা দেখা যায়, কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার পর (বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা) যখন সাদা ধোঁয়া দেখা যায়, তখন নিশ্চিত হয় যে, ক্যাথলিকরা তাদের নতুন আধ্যাত্মিক নেতাকে খুঁজে পেয়েছে।
নির্বাচনে কতটি ব্যালট লেগেছে তা এখনো অজানা, তবে সাম্প্রতিক নির্বাচনের ইতিহাস অনুযায়ী এটি সাধারণত দুই দিনের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। ২০০৫ সালে পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ চারটি ব্যালটে এবং ২০১৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস পাঁচটি ব্যালটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ঐতিহ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের পর নতুন পোপ ‘রুম অব টিয়ার্স’-এ যান—যেখানে সদ্য নির্বাচিত পোপেরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো পোপের পোশাক পরিধান করেন। এরপর তিনি সিক্সটিন চ্যাপেলে ফিরে কার্ডিনালদের আনুগত্য গ্রহণ করেন। এরপর বাসিলিকার বারান্দায় একজন জ্যেষ্ঠ কার্ডিনালের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়—‘হাবেমুস পাপাম’—আমাদের পোপ এসেছেন।
নতুন পোপের আগমনে উচ্ছ্বসিত জনতা রোমাঞ্চিত স্বরে চিৎকার করে ওঠে—‘হাবেমুস পাপাম! ভিভা ইল পাপা!’ এরপর তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন এবং তার প্রথম ‘আর্বি এৎ অর্বি’ (শহর ও বিশ্বের উদ্দেশে) আশীর্বাদ প্রদান করেন।
পাস্টর না কূটনীতিক?
বিশ্ব রাজনীতির জটিল প্রেক্ষাপট এবং ক্যাথলিক চার্চের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য এই নির্বাচনের ফলাফলে বড় ভূমিকা রেখেছে। পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন অভিবাসী ও পরিবেশবান্ধব নীতির একজন দৃঢ় সমর্থক, কিন্তু অনেক রক্ষণশীল তাকে নীতির রক্ষক হিসেবে না দেখে অসন্তুষ্ট ছিলেন। যদিও নব্বই শতাংশ কার্ডিনালই ফ্রান্সিসের মনোনীত, তবুও তার অনুসারী কেউ নির্বাচিত হবেন কিনা, তা নিশ্চিত ছিল না।
নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল—নতুন পোপ কি একজন ধর্মগুরু হবেন, নাকি একজন কূটনীতিক? তিনি কি উদারপন্থি হবেন, নাকি রক্ষণশীল? তিনি কি গির্জা পরিচালনা পর্ষদ, কুরিয়ার বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখবেন, নাকি আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার মতো বাইরের অঞ্চল থেকে আসবেন? যেখানে খ্রিষ্টধর্ম দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। কার্ডিনালদের কনক্লেভের আগে ডিন জিওভান্নি বাটিস্তা রে তাদের এমন কাউকে বেছে নেওয়ার আহ্বান জানান, যিনি চার্চের ঐক্য রক্ষা করতে পারবেন।
বিশ্বের এই জটিল পরিবর্তনের মুহূর্তে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি আধুনিক যুগে ক্যাথলিক চার্চকে টিকিয়ে রাখার বিশাল চ্যালেঞ্জও নতুন পোপের সামনে। কারণ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পুরোহিতের সংখ্যা এবং চার্চে উপস্থিতির হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
পোপের অভিষেক সাধারণত নির্বাচনের এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে এক বিশাল উপাসনার মধ্য দিয়ে এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রথমবারের মতো পোপ একটি মোবাইল গাড়িতে করে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের চারদিকে ঘুরে দর্শনার্থীদের সম্ভাষণ জানাবেন এবং এরপর একটি ভাষণে তার ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারের কথা তুলে ধরবেন।