নতুন পাইপ বসাতে তিতাসের ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা

লিকেজ বন্ধ করে গ্যাসের অপচয় রোধ এবং দুর্ঘটনা কমাতে নতুন করে গ্যাস লাইন স্থাপন করতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার একটি বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের পুরান গ্যাস পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা হবে।
সরকারি তথ্যমতে, ‘ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যমান গ্যাস নেটওয়ার্কের প্রতিস্থাপন ও উন্নয়ন, জিআইএস ম্যাপিং এবং তত্ত্বাবধায়ক নিয়ন্ত্রণ ও ডাটা অধিগ্রহণ (এসকাডা) সিস্টেম সংযুক্তিকরণ’— শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সময়মতো পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন না পেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো লিকেজ বন্ধ করে জিআইএস ও এসকাডা প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় ২৫ লাখ গ্রাহককে নিরাপদে গ্যাস সরবরাহ ও বিতরণ করা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করবে সরকার ও তিতাস গ্যাসের নিজস্ব তহবিল। বাকি অর্থায়ন করবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ‘জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো গ্যাস লিকেজ শনাক্ত ও মেরামত করা সম্ভব হবে।’
এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে গ্যাস লিকেজের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের গ্রাহকদের জন্য গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা ২৭৫ এমএমসিএফডি থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮ এমএমসিএফডি পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এ কারণে গ্যাস স্টেশনের উভয় পাশে প্রায় ২ হাজার ৭৮১ কিলোমিটার গ্যাস লাইন স্থাপন করা হবে।
তাছাড়া প্রকল্পটিতে ৫ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য কার্বন নিঃসরণের ব্যবস্থা করে প্রতি মাসে গ্যাস লিকেজ দুর্ঘটনা কমিয়ে ৬৬টিতে নামিয়ে আনার পরিকল্পনাও রয়েছে।
তবে প্রায় আট মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে। এতে প্রকল্পটি সময়মতো বাস্তবায়ন না-ও হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পুরাতন, ঝুঁকিপূর্ণ পাইপলাইনগুলো আধুনিক করার জন্য তিতাস ইতোমধ্যেই একটি টেকনো-ইকোনমিক স্টাডি সম্পন্ন করেছে।
সরকারি সূত্রে আরও জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর পুরোনো পাইপলাইন প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনার জন্য তিতাসের লিকেজ পাইপলাইনকেই দায়ী করা হয়েছে।
২০২৩ সালের জুন মাসে মগবাজারে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে অন্তত ৬ জন নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হন। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে তিতাস গ্যাস লাইনের লিকেজ থাকার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
এর চেয়েও বড় দুর্ঘটনা ঘটে ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি মসজিদে। সেখানে তিতাসের একটি গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে ছয়টি এসিতে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কমপক্ষে ২৭ জন নিহত এবং আরও অনেকেই আহত হন। এটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গ্যাস দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।
এছাড়াও, সম্প্রতি তিতাস স্মার্ট প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপন শুরু করলে গ্রাহক ও সরবরাহ উভয় দিকেই গ্যাস লাইনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লিকেজ পাওয়া যায়।
দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তিতাস বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার ১৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই গ্যাস নেটওয়ার্কের একটি বড় অংশ অত্যন্ত পুরোনো, যার অনেক পাইপলাইন ৪০ থেকে ৫০ বছর আগে স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক লাইনেই গঠনগত দুর্বলতা দেখা দিয়েছে এবং ঘন ঘন লিকেজ ও দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়েছে, ফলে অবিলম্বে প্রতিস্থাপন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।